Saturday, July 10, 2021

গুণী পরিচালক কি আমরা হারিয়ে ফেলছি



আক্ষেপ

     রাজিব: তোমার বাবা কী করেন?
     রিয়াজ: আমার বাবা নেই।
     রাজিব: ছি ছি! ওভাবে বলতে নেই। বলো, "আমার বাবা বেঁচে নেই।"

      সিনেমার নামটা আমার মনে নাই। কিন্তু অন্তত ১০/১২ বছর আগে দেখা সিনেমাটার একটা দৃশ্য এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে এ অসাধারণ কথোপকথনটার জন্য। গল্প তখনকার গতানুগতিক প্রেমের গল্পের মতই। গরীব মায়ের একমাত্র ছেলে রিয়াজ। তার বাবা বেঁচে নেই। প্রেম করে বড়লোক বাবা রাজিবের মেয়ের সাথে (নায়িকা কে ছিল সিউর না। যথাসম্ভব শাবনুর।)। তো নায়িকার বাবার সাথে পরিচিতি পর্ব চলছে। বড়লোক নায়িকার সুবিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ির নীচতলায় সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে নায়ক আর নায়িকার বাবার উক্ত কথোপকথন।

     তখন তো বেশ ছোটোই ছিলাম। তখনই কথাগুলো মনে ধরে। এখনও ভাবি কী চমৎকার লেখনি আর স্মার্ট ভাবনা। "আমার বাবা নেই" কথাটা দিয়েই কিন্তু বুঝা যায় বাবা বেঁচে নেই। পরবর্তী ডায়লগের প্রয়োজন পড়ে না। অথবা চাইলে প্রথমেই নায়কের মুখ দিয়ে "আমার বাবা বেঁচে নেই" বলিয়ে সারতে পারতো। তবুও লেখক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সেটাকে অপমানের একটা হাতিয়ার হিসাবে কী সুন্দর ব্যবহার করেছেন। সাথে রাজিবের স্যার্কাস্টিক অভিব্যক্তিতে কী "দূর্দান্ত অপমান"। আর এখন? একজন লিখেন, "সুন্দরবনে শুধু বাঘই না, সিংহও থাকে"। আরেকজন তো সিনেমার নামই রেখে দেন 'তারকাটা'। এ শুধু দুটো উদাহরণ। এমন অসংখ্য অসংগতি হরহামেশাই চোখে পড়ে। এর কারণ কী? আমার যা মনে হয় মানসম্মত স্ক্রিপ্ট রাইটারের অভাব। আমাদের তো সিনেমার হিরোই সব। তারপর নাম আসে প্রডিউসার ডিরেক্টরের। কোনো রকম একটা দায়সারা প্রোডাকশন করতে পারলেই হয়। স্ক্রিপ্ট বা স্টোরি রাইটারের মূল্যই কতটুকু। কে খোঁজ রাখে কোন গল্প, কোন স্ক্রিপ্ট কে লেখে! অথচ একটা ভালো সিনেমার সবচেয়ে জরুরি বিষয়, ভালো ডিরেক্টরের পরই ভালো স্ক্রিপ্টের। ভারতের আমির খান তার সিনেমার ক্রেডিটে ডিরেক্টরের পরই নাম রাখেন স্ক্রিপ্ট রাইটার বা গল্পকারের। তারপর আসে প্রডিসারের নাম (সেটা হোক তিনি নিজেই)। সিনেমা একটা শিল্প। সিনেমার সাথে জড়িত প্রতিটা ব্যক্তিই একজন শিল্পী। কাজেই সবগুলো সেক্টরেই থাকা চায় শিল্পের ছোঁয়া।

     অথচ বেশি দূরে না, কলকাতার ইন্ডাস্ট্রির দিকে তাকালেই হয়। তাদের কিছু কিছু কাজ দেখলে অভিভূত হতে হয়। মনে হয় যেন কোনো সাহিত্যকর্ম। সৃজিত মুখার্জি, ঋতুপর্ণ সেন, গৌতম ঘোষদের সিনেমা দেখলে মনে হয় যেন কোথায় বিভোর হয়ে আছি। তাদের সিনেমায় যেমন বিনোদন থাকে তেমনি একেকটা সিনেমা যেন সাহিত্য, ইতিহাস, মনস্তত্ত্বের ভাণ্ডার। আর প্রসেনজিৎ, আবির, পরমব্রত, ঋতিক, রাইমা তাদের দেখলে তো আমার একরকম হিংসাই হয়। কী চমৎকার অভিনয়, সাথে স্মার্ট বাচনভঙ্গি। তারা সকলেই প্রচুর পড়াশুনা করেন। ইতিহাস, সাহিত্য সমন্ধে তাদের জ্ঞান বিস্তর। এগুলোর প্রভাব সহজেই চোখে পড়ে সিনেমায়। 

      কিন্তু এ কলকাতাতেই একসময় রিমেক হতো বাংলাদেশের সিনেমার। বেশি না, ২০/২৫ বছর আগেই। আজকের বিখ্যাত প্রসেনজিৎ অভিনয় করেছেন বাপ্পারাজের চরিত্রে। রচনা ব্যানার্জির পায়ের নীচে মেঝেতে গড়াগড়ি করে উদ্যম নৃত্য করা প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি আজ কোথায় পৌঁছে গেছেন! আর আমাদের সকলের প্রিয় বাপ্পারাজ তো একরকম অভিনয়ই ছেড়ে দিয়েছেন।
     
     তারপর আসে কন্টেন্টের কথা। অনেক আগে বা সাদাকালো যুগেও যাওয়া লাগে না। নব্বই দশকই যথেষ্ট। কন্টেন্টে কত ভ্যারিয়েশন ছিলো। নির্মিত হয়েছে রাজা-রাণী, জমিদারদের নিয়ে সিনেমা, হয়েছে ইতিহাস নির্ভর সিনেমা। সোহরাব রুস্তমের মত ভিন্নধর্মী গল্পের সিনেমা। ঘোড়ায় চড়া রবিনহুডের গল্প, পাহাড়ি লোকেশনে ঘোড়ার বহরে ডাকাতের দলের গল্প, সাপ নিয়ে নাগ নাগিনীর সিনেমা। এটা ঠিক যে এখন ওসব রাজা রাণী সাপখোপের সিনেমা ওভাবে চলবে না। কিন্তু 'ওভাবে' চলবে না। আজ প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে। চাইলেই সময়োপযোগী গল্পের সাথে প্রযুক্তি মিলিয়ে সেসবই দর্শকের উপভোগ্য করে তুলা যায়। একটা বিশেষ সিনেমার কথা না বললে তো না-ই। জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন আর রাজ্জাক অভিনীত 'অভিযান'। ১৯৮৫ সালে একটা কার্গো শিপে শ্যুট করা সম্পূর্ণ সিনেমা। এত আগে কী সাহসী একটা প্রোডাকশন। উল্লেখ্য, সিনেসাটার কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। কমেডি থ্রিলার 'পালাবি কোথায়'-এর কথা না বললেই নয়। আমি দেখেছি এমনই আরো অনেকগুলো নাম বলা যাবে চমৎকার এন্টারটেইনিং কিন্তু ভিন্ন ধাচের সিনেমার।

        আশার বিষয় এখন নতুন কিছু নির্মাতাদের হাত ধরে নতুন কন্টেন্টের কাজ হচ্ছে। তবে সেখান থেকে অফ ট্র্যাক বাদ দিলে যা থাকে তা প্রায় একই ঘরানার। একশন থ্রিলার। বানিজ্যিক সিনেমায় ভিন্নতা এখনো তেমন আসেনি। প্রশ্ন আসে বাজেট নিয়ে। কিন্তু এখন বাজেট তেমন ইস্যু না। আমাদের শতকোটির প্রোডাকশন প্রয়োজন নেই। হাতের নাগালের বাজেট দিয়েই ভালো কন্টেন্টের সিনেমা প্রস্তুত সম্ভব। এরজন্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ দক্ষিণ ভারতের মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রি। চমৎকার সব কাজ। হাতাহাতি মারামারিতে পায়ের জুতা খুলে গেলো। একে কেন্দ্র করে দুই ঘন্টার সিনেমা। একটা সামান্য চেইন ছিনতাইকে ঘিরে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। দুই বন্ধুর বাইক নিয়ে ট্রিপে বের হওয়া থেকে তিন ঘন্টার দারুণ উপভোগ্য রোড ট্রিপ সিনেমা। দেখলেই মন ভরে যায়। 

     কন্টেন্ট আমার মতে মাটির মত। কেউ তাতে পানি ঢেলে ঢেলে কাদা বানায়। কেউ অতিযত্নে চমৎকার পুতুল বানান। আমাদের পুতুলের কারিগরের অভাব-অন্তত আপাত দৃষ্টিতে। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী তা ঠিক জানি না। তবে আমার যা মনে হয় তা হলো একাগ্রতা। সিনেমাকে মনে প্রাণে ভালবেসে, অনুভব করে তৈরি করা। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর সিনেমা দেখা। সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ক্রিয়েটিভ কাজ করা। ভালো নির্মাতাদের এগিয়ে আসা। নতুন এবং মৌলিক গল্পের সিনেমা তৈরি। মৌলিক এবং নতুন প্রতিভাবান লেখকদের সুযোগ দেওয়া। গল্পের অভাব হবে না, প্রয়োজন সদিচ্ছা।

     আবেগে অনেক কিছুই বলে ফেলছি। বাংলা সিনেমার প্রতি ভালো লাগা থেকে মনোবাসনা বা দুঃখ প্রকাশ করেছি। ভুলত্রুটি মাফ করবেন।

Written by: Bulbul Ahmed

SHARE THIS