Devi (1960) directed by Satyajit Ray_BD Films Info |
দেবী’র নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
ভূমিকাঃ ‘দেবী’ (১৯৬০) বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র
নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ। ‘অপু ট্রিলজি’ এবং ‘জলসা ঘর’ এর
কাজ শেষ করার পরই তিনি ‘দেবী’ চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে হাত দেন। এটি ১৯৬০ সালে
মুক্তি পায়। হিন্দু ধর্ম মতে দেবী হচ্ছে একটি সত্তা, যা স্বর্গীয়, ঐশ্বরিক,
শ্রেষ্ঠত্বকে বুঝায়। এটি একটি স্ত্রীবাচক শব্দ যার পুরুষবাচক শব্দ হচ্ছে দেব।
‘দেবী’ চলচ্চিত্রে দেবী শব্দটি এই চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান চরিত্র দয়াময়ী’কে
বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
দেবী চলচ্চিত্রের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক
পটভূমিঃ
‘দেবী’ চলচ্চিত্রটির সেট নির্মাণ করা হয়েছে ১৮৬০ সালের তৎকালীন
বাংলার জমিদারদের ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও ধর্মের প্রতি অন্ধবিশ্বাস এবং সে সময়ে
এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক,রাজনৈতিক তথা ঐতিহাসিক পটভূমিকে কেন্দ্র করে। সে সময় এমন
একটি সময় ছিল যখন সতীদাহ প্রথা তিন দশক হল বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে মাত্র। অর্থাৎ,
গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিং ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।রাজা
রামমোহন রায় এতে অনেক সহায়তা করেন। এবং সে সময়ে অর্থাৎ ১৯৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। তৎকালীন
সময়ে, হিন্দু সমাজ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দিক থেকে যেমন, শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি,
সমাজনীতি ইত্যাদি দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছিল। তখন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগরসহ এমন অনেক শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং ধর্ম সংস্কারক দের আবির্ভাব
হয়। সে সময়ের সমাজে ধর্মান্ধতা, অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার ইত্যাদি বিরাজমান ছিল। তৎকালীন
সমাজে তাঁদের মত সমাজসংস্কারক, ধর্ম-সংস্কারক, শিক্ষাবিদদের সহায়তায় সমাজের
অশিক্ষিত, কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজের কিছু জনসাধারণ নতুন দিক নির্দেশনা পায়। কিন্তু এ
সংস্কার আন্দোলন সবাই ততটা গ্রহণ করতে পারেনি। তাদের পিতা, পিতামহরা যেভাবে
সংস্কার বা ধর্ম পালন করতেন, তারা ও সেভাবে পালন করতে থাকেন এতে অন্ধ বিশ্বাস ও
কুসংস্কার আর ও দানা বাঁধতে থাকে। ফলে
তারা শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। সমাজের উচ্চবিত্তের কিছু অংশ কেবল শিক্ষা গ্রহন
করতেন। যেমন- ‘দেবী’ চলচ্চিত্রে উমাপ্রসাদ তার পরিবারের কেবল একাই উচ্চ শিক্ষা
গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রাখতেন। তবে ধর্ম-সচেতন
ছিলেন। উমাপ্রসাদ বলেছিলেন যে তার এবং তার পিতার মধ্যে বিদ্যের ব্যবধান এক যুগের।
এতেই আমরা পরিস্কার হতে পারি যে সে সময়ে কতটা অন্ধ বিশ্বাস এবং কুসংস্কার বিরাজ
করত এসব ধর্ম অসচেতন মানুষের মাঝে। ‘দেবী’ চলচ্চিত্রের সেট ১৮৬০ সালের। সে সময়ে
ভারতে ভাইসরয় ছিলেন চার্লস জন ক্যানিং। তিনি ১৮৫৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গভর্নর
জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হলে ১৮৫৮ সালে বৃটিশ রানী
ভিক্টোরিয়া নিজ হাতে ভারতীয় উপমহাদেশের শাসন ক্ষমতা নিয়ে নেন। এবং ১৮৫৮ সালে
ভারতের প্রথম ভাইসরয় এর দায়িত্ব দেন চার্লস জন ক্যানিংকেই। তিনি ১৮৬২ পর্যন্ত
দায়িত্ব পালন করেন। আলোচ্য ঘটনাগুলোর সাথে ‘দেবী’ চলচ্চিত্রের প্রত্যক্ষ কোনো
সম্পর্ক না থাকলে ও ‘দেবী’ চলচ্চিত্রটি সে সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ইঙ্গিত করে
এতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রবর্তনের পর থেকে
জমিদার শ্রেণী সমাজের মাথায় পরিণত হয়। এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর জমিদাররা
একচ্ছত্র অধিপতি হন। স্থানীয়ভাবে তিনিই সমাজের একচ্ছত্র শাসক। ফলে তার নিয়ম, নীতি,
আইন বা কথার ওপর অন্য কারো কথা বলার অধিকার থাকত না। ‘দেবী’ চলচ্চিত্রে কালিকিঙ্কর
একজন তৎকালীন জমিদার। সুতরাং, সমাজে তার কথা, আদেশই আইন যা সমাজের প্রজাদের মেনে
চলতে হত। এর ওপর তাদের কোনো কথা বলার অধিকার ছিলনা। একইভাবে নারীদের ও অধিকার
ছিলনা। শুধু তাই নয়, স্থানীয়ভাবে জমিদাররা সকল ক্ষমতার মালিক ছিলেন। সে ক্ষমতা
তাদের অর্পণ করা হত রাজনৈতিকভাবে। এভাবেই তারা সকল ক্ষমতার অধিকারী হতেন। জমিদাররা
যেসব সিদ্ধান্ত নিতেন সেটা ভালো হলে সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে অনত। অন্যদিকে ভুল
সিদ্ধান্তের ফলে অমঙ্গলের খেসারৎ দিতে হত। কেননা, জমিদারদের কথার ওপর কারো কথা
বলার অধিকার ছিলনা। তবে সে সময়ের জমিদারগণ বেশিরভাগই অশিক্ষিত ছিলেন। ইংরেজি
জানতেন না, এছাড়া ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রাখতেন। এতে অন্ধ বিশ্বাস, ধর্মান্ধতা
এবং কুসংস্কার সৃষ্টি হত। এছাড়া তারা ধর্ম সচেতন ছিলেন না।
‘দেবী’ চলচ্চিত্রের
প্লট বিভাজনঃ
গল্পের
প্লটঃ
‘দেবী’
চলচ্চিত্রটি সত্যজিৎ রায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রচিত ‘দেবী’ কাহিনী অবলম্বনে
নির্মাণ করেছেন। যদিও প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘দেবী’ এবং সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত
‘দেবী’র কিছু চরিত্র এবং ঘটনার অমিল রয়েছে তারপর ও উভয়ের মূল কাহিনী একই।
সত্যজিৎ
রায়ের ‘দেবী’ চলচ্চিত্রটি মূলত একটি জমিদার বাড়ির পারিবারিক কাহিনী নিয়ে। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ
চরিত্রগুলো হচ্ছে জমিদার কালিকিঙ্কর, তার দুই পুত্র ও পুত্র বধূ ও সব চেয়ে বাড়ির
আদরের একজন খোকা, কালিকিঙ্করের দৌহিত্র। যে কিনা তার কাকী দয়াময়ীর কাছে থাকতেই
বেশি ভালবাসে। দয়াময়ী তার বৃদ্ধ শ্বশুর জমিদার কালিকিঙ্কর এর সেবা যত্ন করলেও
বাড়ির বড় বউ হরসুন্দরী অন্যন্য কাজে সাহায্য করেন যদিও বাড়িতে চাকর বাকর রয়েছে।
একদিন কালিকিঙ্কর স্বপ্নে দেখলেন যে তার ছোট বউমা কালী দেবী রূপে তার বাড়িতে
অবস্থান করছেন তাদেরই সেবা যত্ন করছেন। পরে তাকে
কালী দেবীর আসনে বসিয়ে পুজা করতে শুরু করেন।
কালিকিঙ্করের বড় ছেলে তারাপ্রসাদও বাবার মতই বিশ্বাস করেছিলেন যে, দয়াময়ী সত্যি
একজন অবতার।কারন, তিনিও তার বাবার কথার ওপর কথা বলতে পারতেন না। এক সময় একটি মৃত ছেলেকে দয়াময়ীর সামনে তার
চরণামৃত পান করালে ছেলেটি বেঁচে উঠে। এতে সমাজের সকল মানুষ আর ও তার ওপর বিশ্বাস
করতে থাকে যে তিনি এক জন দেবী। যদিও দয়াময়ীর স্বামী উমাপ্রসাদ কখনোই তা বিশ্বাস
করন নি। বরং তিনি তার স্ত্রীকে তার বাবার কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের হাত থেকে
মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। হরসুন্দরীর ছেলে খোকার অসুখ হলে তিনি দয়াময়ীর কাছে দিয়ে যান
ছেলেকে যাতে সে সকালে তার ছেলেকে তার কাছে ফেরত দেয়। খোকা সকালে মারা গেলে দয়াময়ী
নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং মাঠের দিকে দৌড়াতে থাকেন এক সময় মিলিয়ে যায়।
তার স্বামী উমাপ্রসাদ তাকে বাঁচাতে কলকাতা থেকে এসেছিল বটে কিন্তু ব্যর্থ হন।
সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ চলচ্চিত্রের প্লট বিভাজন
নিম্নে দেয়া হলঃ
১।
দুর্গা পূজা উদযাপন ও বিসর্জন
‘দেবী
চলচ্চিত্র শুরু হয় জমিদার বাড়ি ও সমাজের সকলের দুর্গা পূজা উদযাপন ও নদীতে
বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। দেখা যায় বাড়ির বাইরে, জমিদার কালিকিঙ্কর এর পরিবার ও সমাজের
মানুষজনকে নিয়ে পূজা করছেন, পাঁঠা বলী দিচ্ছেন খুব ধূমধাম করে আনন্দের সাথে দুর্গা
পূজা নদীতে বিসর্জন দিচ্ছেন।
Devi (1960) |
Devi (1960) |
দুর্গা পূজা উদযাপন দুর্গা পূজা নদীতে বিসর্জন
Devi (1960) |
স্বামী উমাপ্রসাদ ও স্ত্রী
দয়াময়ী
Devi (1960) |
দয়াময়ী টিয়ের যত্ন নিচ্ছেন
Devi (1960) |
দয়াময়ী খোকাকে গল্প শোনাচ্ছেন
২।
পরিবারের প্রতি দয়াময়ীর সেবা যত্ন ও ভালবাসা
বাড়ির
ছোট বউ দয়াময়ী। তিনি পরিবারের সবাইকে যেমন ভালবাসেন তেমন (জীবজন্তু) টিয়া পাখির
সেবা যত্ন কম করেন না। শ্বশুর জমিদার কালিকিঙ্কর এর সেবা যত্ন করেন, পরিবারের
সবচেয়ে আদরের একজন খোকার যত্ন করেন, লুকিয়ে রাখা জিনিস তাকে খাওয়ান, রাতে নিয়ে
গল্প শোনান তাকে। হরসুন্দরীর কাছে রাতে থাকতে চাইনা খোকা তাই তাকে প্রতি রাতে
দয়াময়ীর কাছে রেখে যান। হরসুন্দরী ও তার স্বামী তারাপ্রসাদ যদিও চান না দয়াময়ীর
কাছে তাকে রেখে কষ্ট দেয়া তারপর ও দয়াময়ী এটা
স্বাচ্ছন্দে করতেই ভালবাসেন। এক কথায় দয়াময়ী বাড়িকে যেমন ভালবাসায় সিক্ত
রাখেন তার স্বামী উমাপ্রসাদকে ও নিজের কাছে ভালবাসায় আটকে রাখতে চান। যদিও
উমাপ্রসাদ তার পড়ালেখার পাশাপাশি সময় দেন তার স্ত্রীকে।
Devi (1960) |
Devi (1960) |
দেবী কালীর প্রতিকী স্বপ্নে কালীরূপে দয়াময়ী
৩।
স্বপ্নাদেশে কালীরূপে দয়াময়ী
জমিদার
কালিকিঙ্কর দয়াময়ীর সেবা যত্নে খুব সন্তুষ্ট। এমন
ও বলেন যে এমন মা ক’জনের আছে যে মা বলার সাথে সাথে মা কাছে এসে দেখা দেয়। একদিন
রাতে কালিকিঙ্কর স্বপ্নাদেশে দেখলেন দয়াময়ী স্বয়ং কালীরূপে তার ঘরে অবস্থান
করছেন। তিনি দয়াময়ীর পায়ে পড়লেন, সাথে বড়
ছেলে তারাপ্রসাদকেও বললেন। তাদের কোন অপরাধ থাকলে ক্ষমা করে দেয়। দয়াময়ী কিছু বলতে
পারলেন না কালিকিঙ্কর এর কথার ওপর। কালিকিঙ্কর
বললেন যে মা দয়াময়ী স্বয়ং অবতার ।
Devi (1960) |
দয়াময়ীকে কালী দেবীরূপে
পূজার্চনা করা হচ্ছে
৪।
দয়াময়ীকে দেবীরূপে পূজার্চনা
ছোট
বউমা দয়াময়ীকে কালীর জায়গায় স্থান দিয়ে জমিদারসহ সমাজের সকলে তার পূজার্চনা শুরু
করেন। দয়াময়ীর কন্ঠে কোনো ভাষা নেই। কেননা, তিনি তার শ্বশুরের কথার ওপর কোন কথা
বলতে পারবেন না। এমন অধিকার তার নেই।
৫।
দয়াময়ীর থাকার ঘর পরিবর্তন ও বঞ্চনা
দয়াময়ীকে
অবতার হিসেবে পূজা করার পর তার থাকার ঘর পরিবর্তন করা হয়। প্রথমে তার ঘর উপরের
তলায় থাকলেও পরে তা নিচ তলায় করা হয়। এখন তিনি তার পরিবারের সেবা যত্ন নিতে পারবেন
না। খোকার যত্ন নিতে পারবেন না। টিয়া পাখিকে খেতে দিতে পারবেন না। কারণ, তিনি
অবতার। অবতারদের এসব করতে দেয়া যাবে না। পরে যদি অমঙ্গল হয়। এখন একা একা দয়াময়ীকে
নিচের ঘরে থাকতে হয়। দেখুশুনার জন্য চাকর রয়েছে। এখন
তিনি সবার কাছ থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। তার পরিবার, স্বামী, খোকা, সবার কাছ থেকে
বঞ্চিত হচ্ছেন।
৬।
উমাপ্রসাদের বাড়ি ফেরত
এত
সব কান্ড হয়ে গেল। উমাপ্রসাদ কিছুই জানেন না। দয়াময়ী হরসুন্দরীকে একটা চিঠি লিখতে
বললেন তার স্বামীকে। উমাপ্রসাদ কোলকাতায় পড়ালেখা করার উদ্দেশ্যে সেখানেই থাকেন।
বন্ধুর সাথে সেখানে সব কছু শেয়ার করেন। তার বন্ধু বিধবা এক মহিলাকে বিয়ে করতে
ইচ্ছুক। কিন্তু উমাপ্রসাদের সাহায্যের প্রয়োজন। উমা প্রসাদ ও রাজি। গল্প করে করে
এসে রাতে হোস্টেলে এসে দেখলেন চিঠি এসেছে বাড়ি থেকে। তার ডাক পড়েছে।। তিন বেরিয়ে
পড়লেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। দেখলেন দয়াময়ীকে কালীর জায়গায় স্থান দিয়ে সবাই পূজা করছে।
তিনি অবাক হলেন। তার বাবার সাথে বিরোধ করে বসলেন এ নিয়ে যে, দয়াময়ী অবতার হতে
পারেনা। তার বাবা পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু কালিকিঙ্কর সাহেব নিজেবে পাগল বলতে ও
নারাজ কারণ, তিনি স্বয়ং স্বপ্নে এমন সংবাদ পেয়েছেন।
Devi (1960) |
নিবারণ তার মৃত নাতিকে নিয়ে
দয়াময়ীর নিকট যাচ্ছে
৭।
দয়াময়ীকে দেবীত্বে প্রতিষ্ঠা
নিবারণ
নামের একজন তার মৃত নাতিকে নিয়ে এসেছেন দেবী দয়াময়ীর কাছে। যাতে তিনি তার নাতিকে
জীবিত ও সুস্থ করে দেন। ছেলেকে চরণামৃত পান করার পর ছেলেটা বেঁচে যায়। এতে সবাই আর
ও বেশি বিশ্বাস করতে লাগলো যে দয়াময়ী অবতার।
কালিকিঙ্কর তার ছেলে উমাপ্রসাদকে প্রমাণ দিয়ে দিলেন যে দয়াময়ী দেবী রূপে
তার ঘরে এসেছেন। দয়াময়ীকে দেবীত্বে প্রতিষ্ঠা করা হল। এরপর আশেপাশের অনেক গ্রাম
থেকে মানুষ আসে তার কাছে রোগ সারাতে। তাকে পূজা করতে।
৮।
দয়াকে নিয়ে পালানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা
উমাপ্রসাদ
তার বাবার কথাকে বিশ্বাস করলেন না। তিনি তার স্ত্রী দয়াময়ীকে স্বীকার করতে বললেন
যে, সে দেবী নয়। দয়াময়ী প্রথমে স্বীকার করলেন তিনি দেবী নন। তার ওপর জোর করে
চাপানো হয়েছে। তাই দয়াময়ীকে বাঁচাতে বা মুক্ত করতে উমাপ্রসাদ সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে
নিয়ে পশ্চিমের কোথাও পালিয়ে যাবেন। রাতে দু জনে পালানোর চেষ্টা করলেন । কিন্তু
দয়াময়ী ডাঙ্গা নদীতে দুর্গার স্কাল্পচার (স্কেলেটন) দেখে ভয় পেলেন। বললেন যদি কোন
অমঙ্গল হয়। তাই তিনি রাজি হলেন না। দুজনে বাড়ি ফিরে গেলেন। দয়াকে নিয়ে পালানো
হলনা।
৯।
খোকার মৃত্যু
উমাপ্রসাদ
কলকাতা চলে যাবার পর খোকার ভীষণ অসুখ হল। হরসুন্দরী দয়াময়ীকে দেবী হিসেবে বিশ্বাস
করেন নি। তাই প্রথমে তার কাছে তার ছেলেকে নিয়ে যান নি। তারাপ্রসাদ খোকার অসুখের
কথা জানতে পারলে তার বাবাকে গিয়ে বলেন। এভাবে তারা অসুস্থ খোকাকে দেবী দয়াময়ীর
কাছে নিয়ে আসেন তাকে, যেন তিনি তাকে সুস্থ
করে দেন। হরসুন্দরী বলেন, ‘ হ্যাঁ রে ছোট বউ, তুই কি সত্যি অবতার?’ দয়াময়ী কিছু
বলেন না। হরসুন্দরী বলেন আমি নিয়ে আসতে চাইনি। দয়াময়ী বলেন আজ রাতটা আমার কাছে থাক।
কাল ফিরিয়ে দিবি ত বলে হরসুন্দরী তার কাছ থেকে স্বীকারুক্তি নেন। দয়াময়ী
হরসুন্দরীকে সকালে তার ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা দিলেন। সকালে খোকা মারা যায়
দয়াময়ীর হাতে। দয়াময়ী তাকে ভালো করতে পারেন নি। দয়াময়ী পাগলপ্রায় হয়ে যান। কেননা
তিনি হরসুন্দরীকে কথা দিয়েছিলেন যে তার ছেলেকে তিনি সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে দিবেন।
কিন্তু তিনি ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হন।
Devi (1960) |
খোকার মৃত্যুতে উমাপ্রসাদ ও
কালিকিঙ্কর এর মনোভাব
১০।
বাসায় উমাপ্রসাদের ব্যর্থ আগমন
কলেজের
শিক্ষক এর সাথে উমাপ্রসাদ এর আলাপ হয়। তিনি তাঁকে ব্যপারটা খুলে বলেন। ১৭ বছর
বয়সের একটি মেয়ের ওপর এসব চাপিয়ে দেয়ে হয়েছে। দয়াময়ী নিজে ও স্বীকার করেন না যে,
তিনি অবতার। আর যে মানুষটা তার ওপর এসব চাপিয়ে দিয়েছেন তার কথার ওপর দয়াময়ীর কোনো
কথা বলার শক্তি, সাহস নাই। শিক্ষক উমাপ্রসাদকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ তিনি নিজে ১৯
বছর বয়সে ধর্ম পরিবর্তন করেন। তার সংস্কারের সাথে তার পিতৃদেব এর সংস্কারের মিল
ছিলনা তাই তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলেন শক্তি, সাহস, বুদ্ধি, বিবেক, চেতনা দিয়ে।
দয়াময়ীর না হয় শক্তি, সাহস নাই। কিন্তু তোমার ত আছে কেন তুমি প্রতিরোধ করতে পারছ
না?’ এমন আলাপের পর উমাপ্রসাদ দয়াময়ীকে মুক্ত করতে বাসা আসেন। কিন্তু দেখলেন খোকা
মারা গেছে। তবু ও তিনি তার বাবার ওপর দায় চাপালেন। এই দিকে দয়াময়ী পাগলপ্রায় হয়ে
গেছেন। তিনি নিজের ওপর ও আত্নবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। আর সে জন্যই তিনি কালীর মত
সেজে মাঠের দিকে পালাতে থাকেন এবং মিলিয়ে যান। উমাপ্রসাদ এসেছিলেন দয়াময়ীকে তার
বাবার অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্ত করতে তিনি প্রতিরোধ করতে এসেছিলেন বাড়িতে। কিন্তু
ব্যর্থ হলেন।
Devi (1960) |
Devi (1960) |
দয়াময়ী কালীর সাজে দয়াময়ী মাঠে
মিলিয়া যায়
ভিজ্যুয়াল
উপাদানের ব্যবহার ও অন্তর্নিহিত অর্থ
‘দেবী’
চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় যে ভিজ্যুয়াল ইমেজ ব্যবহার করেছেন তা ১৮৬০ সালের সেটকে
নির্দেশ করে। যদিও তিনি এটা ১৯৬০ সালে পরিচালনা করেন। ১৮৬০ সালের একটি জমিদার
বাড়িকে ঘিরে সমাজে জমিদারদের ক্ষমতা, জমিদারদের কথার ওপর তখন কেউ কোনো কথা বলতে
পারত না, শিক্ষিত ও ইংরেজি শেখা ব্যক্তিরা ও প্রতিরোধ গড়তে পারত না, জমিদারদের
ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারত না এসব বিষয়কে ‘দেবী’
চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রতক্ষভাবে চলচ্চিত্রটি পারিবারিকভাবে
ঘটে যাওয়া বিষয়কে নিয়ে হলে ও পরোক্ষভাবে এটি গভীরভাবে তৎকালীন বাংলায় রাজনৈতিকভাবে
ঘটে যাওয়া বিষয় বস্তুকে ইঙ্গিত করে। সে সময়ে নারীদের মুক্তির কোন চিন্তা ছিলনা। আতদের
অধিকার ছিলনা। ‘দেবী’ চলচ্চিত্রে ও একই বিষয় লক্ষ্য
করা যায়। জমিদার কালিকিঙ্কর এর কথার ওপর কেউ কোন কথা বলতে পারেনি। যেমন তিনি
বললেন, স্বপ্নে তিনি দয়াময়ীকে কালীরূপে দেখেছেন। এর মানে তিনি ধরে নিয়েছেন যে, তার
ছোট বউমা সত্যি অবতার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত বর্ষে কোন নারী অবতার নেই।
সুতরাং দয়াময়ী ও কোন অবতার হতে পারেনা। কিন্তু সত্যজিৎ রায় নারী চরিত্রটিকে বেছে
নিলেন মূলত সে সময়ের জমিদারদের কুসংস্কারে ডুবে থাকার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার
লক্ষ্যে। সত্যজিৎ রায় ফিল্মের প্রথম সেকুয়েন্সেই পূজা উদযাপনের ইমেজ দেখিয়েছেন।
তার মানে পরিবারটি অতীব ধর্ম বিশ্বাসী। ধর্মাচার করে এমন একটি পরিবারকে তিনি
দেখাবেন। যেখানে পরিবারের মূলে একজন খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কালিকিঙ্কর সাহেব।
তিনি তৎকালীন একজন জমিদার। আগেই বলেছি সে সময়ে জমিদারদের অনেক ক্ষমতা ছিল এবং
তাদের আদেশ, কথাই ছিল সমাজের আইন। সুতরাং এটা মানতে সবাই বাধ্য। দ্বিতীয় কথা হছে
ধর্ম। সে সময়ে সমাজের মানুষ ধর্মের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল ছিলেন। ধর্ম বিষয়ক কোন
আচার না পালন করলে তাদের অমঙ্গল হবে। এমন ভাবনা তদের ছিল। তারা এসবকে খুব ভয়
পেতেন। কিন্তু সত্য খোঁজার কখনো চেষ্টা করেননি। সমাজে শিক্ষিত কেউ একজন যখন এসব কুসংস্কার
প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন কিন্তু একার পক্ষে সম্ভব হয়না। সত্যজিৎ রায় এ বিষোয়গুলো
‘দেবী’ চলচ্চিত্রে পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করেছেন।
সত্যজিৎ
রায় ইমেজের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক শব্দের
ব্যবহার করেছেন। আমরা তার এ চলচ্চিত্রের স্বপ্নের শটটি বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারব।
যেমন, এ শটে স্বপ্নে অলৌকিকভাবে কালী দেবীর ইমেজের সাথে যে শব্দ ব্যবহার করেছেন তা
ইমেজকে অধিকতর প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। যা জমিদার
এর কাছে দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে সত্যি এটা একটি অলৌকিক স্বপ্ন যার মাধ্যমে তিনি ধরে
নিয়েছেন দয়াময়ী স্বয়ং অবতার হিসেবে তার ঘরে এসেছেন। বিষয়টিকে আরও প্রাসঙ্গিক করে
তুলতে সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছেন মৃত ছেলে দেবী দয়াময়ীর চরণামৃত পান করার ফলে বেঁচে
ওঠে। এর মাধ্যমে জমিদার সবার মাঝে আরও বেশি বিশ্বাস ছড়াতে সক্ষম হন। আর সমাজে
অশিক্ষিত ও কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষরা বিশ্বাস না করে পারেনা। কারন এটি স্বয়ং তাদের
সমাজের প্রভু কালিকিঙ্কর বলেছেন। সুতরাং অবিশ্বাস না করলে অমঙ্গল হতে পারে। এ ভয়ে
তারা দলে দলে এসে দয়াময়ীর পূজা করে। তাছাড়া জমিদারের কথা ফেলে দেয়া যায়না। তার
কথার ওপর কোন কথা বলা যায়না। আলোচ্য চলচ্চিত্রে, একটি ছেলে বাঁচিয়ে সত্যজিৎ রায়
সবার মাঝে বিশ্বাস জন্মাতে সাহায্য করেছেন যে দয়াময়ী অবতার। কিন্তু অন্য একটি ছেলে
খোকাকে মেরে তিনি সবার ভুল ভাঙতে সাহায্য করেছেন যে, দয়াময়ী অবতার নয়। সুতরাং এ
দুটি ইমেজ এর ব্যবহার ফিল্মে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।
রেফারেন্স
বিশ্ব
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘দেবী’ গল্পের অখ্যানভাগ বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক প্রভাতকুমার
মুখোপাধ্যায় কে দান করেছিলেন। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় প্রভাতকুমার
মুখোপাধ্যায় রচিত ‘দেবী’ কাহিনী অবলম্বনে তার ‘দেবী’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন। Read More